দফায় দফায় অটোরিকশা নষ্ট হয়ে যাওয়া আর ঠেলাঠেলি শেষে সন্ধ্যার দিকে চারপোল পৌঁছায় দলটি। সেখান থেকে একটি বালুবাহী ট্রলার ভাড়া করে সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে তারা। তবে উত্তাল হাওড় আর মুষল ধারে বৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হয় রাতের অন্ধকার। বারবার দিক হারিয়ে ফেলে ট্রলারের চালক। কয়েকটি চরে আটকে আর স্রোতের বিপরীতে স্বল্পক্ষণের পথ বাইতে লাগে তিন ঘণ্টা। রাত ১০টায় যখন থামে ততক্ষণে উজানের ঢলে তলিয়ে গেছে পুরো সুনামগঞ্জ শহর। হাওড় আর রাস্তার পার্থক্য করাই দায়।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, যেহেতু নৌকাটা (ট্রলার) লোহার ছিল তাই, চালক ভয় পাচ্ছিল বজ্রপাত পড়ে কোনো ক্ষতি হয় কিনা। রাস্তা এবং হাওড়ের জায়গা বোঝা যাচ্ছিল না। মাঝি বলল যে এটাই রাস্তা, তখন আমরা নেমে আসি। নামার পর বুঝতে পারলাম স্রোতে পা রাখা যাচ্ছে না।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোমরসমান পানি পেরিয়ে এবার ঢাকায় ফেরার জন্য বাসের খোঁজ। কিন্তু ততক্ষণে পুরো দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সুনামগঞ্জ। আর হোটেলগুলো হয়ে উঠেছে স্থানীয় বাসিন্দাদেরই আশ্রয়কেন্দ্র।
দুদিনের সফরে গত ১৪ জুন রাতে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয় ঢাবির ২১ শিক্ষার্থীর একটি দল। গত ১৫ জুন টাঙ্গুয়ার হাওড় ও নীলাদ্রি লেকে দিনভর আনন্দ শেষে নৌকাতেই তারা রাত কাটান। পরদিন শিমুলবাগান ও বারিক্কা টিলা ঘুরে রাতে তাদের ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। কিন্তু সকালে শিমুলবাগানের উদ্দেশে নৌকায় যাত্রা শুরুর পর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মধ্যে আটকা পড়েন শিক্ষার্থীরা। ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আর জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে কাটে তাদের তিনটি দিন।
দুঃসহ সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা জানান, শিমুলবাগানের উদ্দেশে নৌকায় যাত্রা শুরুর আধাঘণ্টার মধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর স্রোতে নৌকা এগোতে পারছিল না। বিকল্প হিসেবে বিশ্বম্ভরপুরে গিয়ে সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে চারপোল যাওয়ার কথা ভাবে দলটি। তবে সেখানেও বাধা ভয়ানক স্রোত।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, মাটির একটি স্তূপে আটকে যায় আমাদের লঞ্চটি। এ সময় অতঙ্কিত হয়ে অনেকে আজান দিচ্ছে, মোনাজাত করছে, মোনাজাতে এমনভাবে বলা হচ্ছে যে আমরা আর তীরে ফিরে যেতে পারব না, মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারব না, এটা আমাদের জীবনের শেষদিন।
সবার চেষ্টায় কোনো রকমে চর থেকে ছাড়িয়ে লঞ্চটি যখন ছাতকের পথে, তখন শিক্ষার্থীদের অনেকে ডাকাত ভেবে বসেন।
ছাতকে একটি ঘাটে অপেক্ষার পর সকালে সেনাবাহিনীর দলকে দূর থেকে দেখতে পেলে, প্রাণ ফিরে পাওয়ার আশা জাগে শিক্ষার্থীদের। স্পিডবোটযোগে গোবিন্দগঞ্জে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে গেলে ৩দিন পর ভাত খেতে পায় এই ২১ শিক্ষার্থী। সেখান থেকে সিলেট বিমানবন্দরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সেনাপ্রধান।
শ্রেণিকক্ষে ফেরার পাশাপাশি উদ্যোগ নিয়েছেন সুনামগঞ্জে বন্যাদুর্গতদের সহায়তার। ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে তারা বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছেন।