ঢাকারবিবার, ২৮শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

আজ ২৭ জুন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এর ১২২তম জন্মবার্ষিকী

ইমরান রহমান অনিম
জুন ২৭, ২০২২ ৮:২৩ অপরাহ্ণ / ই-প্রিন্ট ই-প্রিন্ট
                                                       
                           
Link Copied!
ই-প্রিন্ট ই-প্রিন্ট                            

তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম মহান নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ। কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তনে, মেহনতি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া এক ত্যাগী মানুষের নাম। বিত্ত-বৈভবে ভাসিয়ে দিতে পারতেন নিজেকে। আত্মসর্বস্ব ভোগ-বিলাসী জীবনে মত্ত হয়ে বিলাসী ভাবধারায় যেতে পারতেন অন্য জগতে। কিন্তু সে রকম কিছু হননি। বরং ত্যাগের মহিমায় আত্মাকে গড়ে তোলেন মানুষের জন্য। কৃষক-শ্রমিকের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করেন নিঃস্বার্থভাবে। কৃষক যেন তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায়সঙ্গত ভাগ পান, এজন্য নিরলস সংগ্রাম করেন। জোতদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি হন কৃষকের নয়নমণি।
১৯০০ সালে দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। এ অঞ্চলের একজন ছোট জোতদার মৌলভী সালামত উদ্দীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র তিনি। নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হলে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাস করেন। পরবর্তীতে ভারতের উত্তর প্রদেশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং আইনে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। ঠাকুরগাঁও আদালতে প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দিনাজপুর এস.এন কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতাও করেন। এক পর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে যখন জোতদার-জমিদারদের শোষণ, ইংরেজদের দুঃশাসন আর মহানন্দা নদীর করালগ্রাসে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল, যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধছিল, সে রকম একটি সময়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হজ্জ পালন করেছিলেন মোহাম্মদ দানেশ। সে কারণে তিনি অল্প বয়স থেকে ‘হাজী’ পরিচিতি পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট ধারার রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কৃষকের ভাগ্যবদলের চেষ্টা করেছিলেন। তাই পরিচিতি পেয়েছিলেন কৃষকের নয়নমণি হিসেবে।
৩২ বছর বয়সে হজ পালন করতে গিয়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ সৌদি পুলিশ দ্বারা ভারতীয়দের নানাভাবে নির্যাতিত হতে দেখেন। ফলে তাঁর মনের ভেতর বিরূপ রেখাপাত তৈরি করে। ব্রিটিশ গোলামির কারণেই ভারতীয়রা সবখানে লাঞ্ছনা ও অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে বলে তাঁর বোধ হয়। এ অত্যাচার তাঁর মধ্যে বিদ্রোহের সৃষ্টি করে। মনোজগতে পরিবর্তন আনে। সেই পরিবর্তন থেকে তিনি ব্রিটিশ গোলামির বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট ভাবধারার রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৩৭ সালে কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়ে কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট থাকেন। দিনাজপুরে কৃষক সমিতির শাখা গঠন করেন, যার অফিস করা হয় জেলা শহরের মুন্সীপাড়ায়। এ সংগঠনে থেকে তিনি কৃষকদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে তোলাবাটি আন্দোলন ও সুদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলে বিজয় লাভ করেন। এভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে কৃষকের পক্ষে, দরিদ্র মানুষের পক্ষে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নেতৃত্বে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়।
ব্রিটিশ শাসনের শেষপর্যায়ে দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন গড়ে ওঠে কৃষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে। দিনাজপুর থেকে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ ও কমরেড গুরুদাস তালুকদার। এ আন্দোলন ১৯টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং একটি বিরাট গণআন্দোলনের রূপ নিয়ে গোটা ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এ আন্দোলন করতে গিয়ে কেবল দিনাজপুরেই ৪০ জন কৃষক জমিদার ও ব্রিটিশ শাসনপুষ্ট বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। হাজী দানেশের বলিষ্ঠ রাজনীতি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাই ইংরেজ সরকার ১৯৩৮ সালে তাকে গ্রেফতার করে। বেশ কিছুদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়। তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাজী দানেশ ব্রিটিশ শাসকদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ালে আবারো তাকে গ্রেফতার করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। নীলফামারী জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী দানেশ। সম্মেলনের পর পরই তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন।
হাজী দানেশ ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান অব্যাহত রাখার কারণে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ওই বছরই তিনি বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৭ সালে মুক্তিলাভ করেন। ইংরেজ শাসন অবসানের পর হাজী দানেশ নতুন ধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি ১৯৫২ সালে ‘গণতন্ত্রী দল’ গঠন করেন। দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৭ সালে গণতন্ত্রী দল বিলোপ করে তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং দলের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯৬৯ সালে কারারুদ্ধ হন। আইয়ুবের পতনের পর মুক্তি লাভ করেন ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন এবং ভারতের মাটিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পুরো সময় কাজ করেন। স্বাধীনতা লাভের পর দলীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধ হলে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। বাকশাল সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবিত করেন। কিন্তু ১৯৮০ সালে এ দল বিলোপ করে হাজী দানেশ গণতান্ত্রিক পার্টি নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে গণতান্ত্রিক পার্টি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত করা হয়। হাজী দানেশ জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় কৃষক পার্টির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি দিনাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।রাজনীতিতে একটি বিরাট কর্মময় জীবনের ইতিহাস রেখে হাজী দানেশ ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন ভোর ৪টা ২৫ মিনিটে ঢাকা পিজি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবনের শেষ সময়ে দিনাজপুর জেলা শহরের বালুবাড়ীতে বসবাস করতেন। এখন দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ ময়দানে শুয়ে আছেন অনন্তনিদ্রায়।
হাজী দানেশ রাজনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখার জন্য ১৯৮৩ সালে দৈনিক তিস্তা পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। এরশাদের শাসনামলে তাঁর সম্মানে দিনাজপুর কৃষি কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল ‘হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি মহাবিদ্যালয়’। শেখ হাসিনার শাসনামলে এ মহাবিদ্যালয়কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। নাম রাখা হয় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর নামে বোচাগঞ্জের সুলতানপুরে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, এতিম খানা এবং ঠাকুরগাঁও শহরেও একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা রয়েছে।