নানা সংকটের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের চামড়া শিল্প। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া কেনা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, চামড়া কেনার মতো টাকা তাদের হাতে নেই; আবার ব্যাংকঋণও মিলছে না।
হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সরকার ‘রেড জোন’ ঘোষণা করায় মালিকরা সেই জমি না পারছেন বিক্রি করতে, না পারছেন বন্ধক রেখে ব্যাংকঋণ নিতে। আবার সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরীতে এখনো প্রস্তুত হয়নি কঠিন বর্জ্য শোধনাগার। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্প না হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্রও দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কঠিন সময় পার করছেন ট্যানারি মালিকরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাভারে চালু থাকা ১২৩টি ট্যানারির বেশির ভাগই চীনে চামড়া রপ্তানি করে।
মহামারীর প্রভাবে চীনে রপ্তানি বন্ধ থাকায় অনেক চামড়া পড়ে আছে। চীনের ক্রেতারা ট্যানারিতে চামড়া পরিদর্শনে আসেননি। রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেও। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, ৯০ শতাংশ ট্যানারি বন্ধের পথে। চামড়া রপ্তানি না হওয়ায় ট্যানারিগুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে। এতে ঋণের সুদ বাড়ছে। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বেশির ভাগ ট্যানারি খেলাপি হবে। এ সংকট উত্তরণে সরকারের সহায়তা দরকার।
উদ্যোক্তরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাংকঋণে তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হোক। ট্যানারি মালিক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত, সেসব প্রতিষ্ঠানকে দায়দেনা পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর সময় দেওয়া যাবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৫ কোটি টাকার বেশি, তাদের দায়দেনা পরিশোধের জন্য সময় দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ ৫ বছর।
এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনের লক্ষ্যে শিল্প স্থানান্তর করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা অপরিকল্পিতভাবেই হয়েছে। এ কারণে ইউরোপের বাজার হারাতে হয়েছে। এরপর চামড়া খাতে রপ্তানির বড় বাজার ছিল চীন। একক দেশ হিসেবে চীনে ৬৫ শতাংশ চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি করা হয়। এ সময়ে যে পরিমাণ ঋণপত্র, রপ্তানি আদেশ ও পণ্য সরবরাহ হওয়ার কথা, মহামারীর কারণে তা হয়নি। এতে ব্যবসায়ীরা নতুন করে সংকটে পড়েছেন। ইতোমধ্যে ১০ থেকে ১৫টি মাঝারি ট্যানারি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বেশির ভাগ ট্যানারি চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দিলজাহান ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে চামড়া শিল্প মহাসংকটের মধ্যে আছে। ব্যবসায়ীদের হাত খালি। ঋণের জালে জর্জরিত। ব্যাংকঋণ দিচ্ছে না। অন্যদিকে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে সরকার ‘রেড জোন’ দিয়ে রেখেছে। এর ফলে ওই জমি কিছুই করা যাচ্ছে না। ওই জমি না বিক্রি করা যাচ্ছে, না বন্ধক রেখে ব্যাংকঋণ নেওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সহায়তা ছাড়া এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
সংকট শুরু যেভাবে
২০১৭ সালের আগস্টে হাজারীবাগের ২২৫টি ট্যানারি কারখানা একদিনে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রভাবে নামিদামি বিদেশি ক্রেতাদের অধিকাংশই চলে যান। মূলত এরপর থেকেই এই শিল্পের সংকট তীব্র হয়।
সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে আসার পর এই শিল্পের রপ্তানি বাড়ার কথা থাকলেও কমেছে। কারণ সাভারের হেমায়েতপুরে যেখানে এই শিল্প স্থানান্তর করা হয়েছে, সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) তখনো প্রস্তুত করা হয়নি। ডাম্পিং স্টেশন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সবকিছুই অসম্পূর্ণ ছিল।
চামড়া খাতকে এক সময় সম্ভাবনাময় মনে করা হলেও এটি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় শীর্ষ এই রপ্তানি খাত এখন চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে।
পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী সাভারে স্থানান্তরে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষের কথা ছিল। কিন্তু ১৯ বছর পার হয়ে গেলেও এই শিল্পনগরী পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠেনি।
প্রকল্প শেষ না হলেও ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত হাজারীবাগের চামড়া কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেন। ফলে সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে বেশকিছু চামড়া কারখানার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের’ (এলডব্লিউজি) সনদ ছিল। এ সনদের সুবাদে তারা জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া রপ্তানি করতে পারত। হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ হওয়ায় সেই সনদ ও বায়ার (বিদেশি ক্রেতা) হারায় কারখানাগুলো। এত দীর্ঘসময়েও সাভারের চামড়াশিল্প নগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় এখনো এলডব্লিউজির সনদ ফিরে পায়নি কারখানাগুলো। একই সঙ্গে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়নি।