ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের যাতায়াত বা যোগাযোগ বেশ দুরূহ। কেবল আকাশপথ ছাড়া স্থল ও নৌপথে সেখানে যেতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়। সেজন্য মূল ভূখণ্ড থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত রাজ্যগুলোতে পণ্য আনা-নেওয়া বেশ ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য। অন্যদিকে ভৌগোলিক দিক থেকে সাত রাজ্যের একেবারে কাছাকাছি অবস্থান বাংলাদেশের। এই অবস্থানই অপার সম্ভাবনা হয়ে ধরা দিয়েছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য।
ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল- এই সাত রাজ্য বা সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে প্রথম তিনটিতে আগে থেকেই বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাকি চার রাজ্যেও ধীরে ধীরে বাড়ছে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার তৈরি হতে পারে সেভেন সিস্টার্সে। দু-পক্ষের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলে উপকৃত হবেন বাংলাদেশ ও ভারতের সাত রাজ্যের নাগরিকরাও।
সাত রাজ্যের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত আছে ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম ও মেঘালয়ের। এর মধ্যে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের সঙ্গে বন্দর রয়েছে বাংলাদেশের। মূলত এ তিনটি রাজ্যের সীমান্ত দিয়েই উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশ করে বাংলাদেশের পণ্য।
গৌহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের তথ্য মতে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এ অঞ্চলে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি। এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছর সেখানে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪০ কোটি টাকার। বিপরীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেভেন সিস্টার্স থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ৩৯০ কোটি টাকার পণ্য, আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেখান থেকে এসেছে ৪৭২ কোটি টাকারও বেশি পণ্য।
বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বে ভারতের সাত রাজ্যের অবস্থান
জানা যায়, এসব রাজ্যে বাংলাদেশি যেসব পণ্যের চাহিদা আছে, তার মধ্যে আছে- তৈরি পোশাক, লোহা, সিমেন্ট, টিন, ইলিশ, শুকনো খাবার, জুস, চিপস, কনফেকশনারি আইটেম, কটন, প্লাস্টিক ফুটওয়্যার, স্যান্ডেল, প্লাস্টিক টেবিল, কিচেন ওয়্যার, জামদানি শাড়ি, কাঁচা পাট, মিনারেল ওয়াটার, চানাচুর, সস, মোটর ডাল, আইসক্রিম, ইমারজেন্সি লাইট, কনডেন্সড মিল্ক ইত্যাদি।
অন্যদিকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে কয়লা, আদা, পেঁয়াজ, শুকনো মরিচ, পোলট্রি খাদ্য, ডিম, কাপড়, চিনি, অটো পার্টস, বিভিন্ন ফল, প্রকৌশল পণ্য, টিউবলাইট ইত্যাদি বাংলাদেশে রপ্তানি হয়। এছাড়া আসামে তুলা, চা, চুন, পেট্রোলিয়াম পণ্য, লোহা, বিভিন্ন পাথর উৎপাদিত হয়, এসবেরও বাজার আছে বাংলাদেশে। মণিপুরে উৎপাদিত হয় তেল, বিভিন্ন বীজ, সরিষা, ধান, গম, চুনাপাথর ও ক্রোমেট। আর মেঘালয়ে কাচ, চীনামাটি, আকরিক এবং অরুণাচলে ভুট্টা, গম, সরিষা, ডাল, আপেল, কমলা, আঙুর ইত্যাদি উৎপাদন হয়, এসব পণ্যেরও চাহিদা আছে বাংলাদেশে।
গৌহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার ড. শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুর বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্যাকেজ ফুড, সিমেন্ট, প্লাস্টিক ও পোশাক পণ্য রপ্তানির বড় বাজার হতে চলেছে এই অঞ্চল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সার্বিক সহায়তা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দুই অঞ্চলের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত করতে যোগাযোগ ও বন্দর ব্যবস্থাপনা আমাদের আরও উন্নত করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের (আসাম) সফর এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আসামের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্বশর্মা/ছবি: জাগো নিউজ
সম্প্রতি আসাম সফররত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্বশর্মাও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। আসাম থেকে বাংলাদেশে ডিজেল সরবরাহের সমঝোতা স্মারক রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এখানে পণ্য আমদানিরও চুক্তি রয়েছে। আমরা উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক এমন অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে আরও জোর দিচ্ছি।
এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ জানিয়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেন, ঢাকা-গৌহাটি রুটে আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা নিয়মিত ফ্লাইট চালু করবো। করোনা মহামারির আগে গৌহাটি-শিলং-সিলেট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আমাদের বাস চলতো। করোনার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার এটি চালুর জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেয়েছি। আশা করছি এই রুটে বাস সার্ভিসও দ্রুত চালু হয়ে যাবে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হবে।